মোবাইল ফোনের সাহায্য নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে চলছে অসদুপায় অবলম্বন। পরীক্ষা কেন্দ্রের অসাধু শিক্ষক ও কর্মকর্তা এবং সরকারি দলের ছাত্র নেতাদের যৌথ প্রয়াসে চলে এই অসৎ প্রক্রিয়া। যুক্ত রয়েছে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নষ্ট মেধাবী ছাত্ররাও।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নিয়োগ পরীক্ষায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ডিজিটাল কারচুপির ভয়ংকর সব তথ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরীক্ষা কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ থাকলেও পর্যবেক্ষক শিক্ষক ও পরীক্ষার্থীরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। কতৃর্পক্ষের মনিটরিং না থাকায় পরীক্ষা হলে মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে চলছে ডিজিটাল জালিয়াতি। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অসৎ উপায় অবলম্বনকারীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না প্রকৃত মেধাবীরা। সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করছে অযোগ্য ও অসৎ লোক।
২০১১ থেকে ২০১৩ এই কয়েক বছরে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মোবাইলে ডিজিটাল কারচুপির বিভিন্ন দিক। প্রথম মোবাইলে এসএমএস এর মাধ্যমে পরীক্ষায় জালিয়াতির বিষয়টি সামনে আসে ২০১০ সালের অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ১০ জনের একটি চক্র গ্রেপ্তার হলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার প্রমাণ হতাশ করে দেশবাসীকে। এরপর থেকে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাতেও চলে ডিজিটাল এই জালিয়াতি।
সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষাতেও মোবাইল ফোনে এসএমএস এর মাধ্যমে চুক্তিগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে যায় উত্তর। ২৮৮ অক্ষরের এসএমএস এ ৭৫ টি প্রশ্নের উত্তর, ১ডি ২বি ৩বি…. ক্রমানুসারে পাঠানো হয়েছিল। এ নিয়োগ পরীক্ষায় মাত্র এক সেট প্রশ্ন থাকাতে আরো সুবিধা হয়ে যায় দুষ্কৃতিকারীদের জন্য। তবে পরীক্ষার আগেই প্রশ্নফাঁস হয়ে যাওয়াতে খুব বেশি কাজে আসেনি এ ডিজিটাল প্রক্রিয়া।
যেভাবে এসএমএস জালিয়াতি
পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে পরীক্ষায় এসএমএস জালিয়াতির তথ্য। পরীক্ষা শুরু হওয়ার ৫ বা ১০ মিনিটের মধ্যে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র বাইরে চলে যায় একটি চক্রের হাতে। প্রশ্ন বের করতে সহায়তা করে, কেন্দ্রের শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্রনেতারা।
চক্রের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইবিএ, বুয়েটের কয়েকজন ছাত্র প্রশ্নের দ্রুত সমাধান করে। মিনিট ১০ এর মধ্যে আবার কেন্দ্রের পিয়ন দ্বারা প্রশ্নোত্তর চলে যায় কেন্দ্রের ভেতরে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মোবাইলে এসএমএস এর মাধ্যমে ক্লায়েন্ট পরীক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনে চলে যায় উত্তর। এ জন্যে চাকরিপ্রার্থী ক্লায়েন্টকে অগ্রীম গুণতে হয় ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত।
যেসব কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ
অনুসন্ধানে রাজধানীর নামী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বেরিয়ে এসেছে। প্রায় সকল নিয়োগ পরীক্ষারই কেন্দ্র থাকে এসব কলেজ। প্রশ্নফাঁস, কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন বের করা ও ক্লায়েন্ট ধরার এসব প্রক্রিয়ায় কলেজগুলোতে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। যেগুলোর বেশিরভাগেরই নেতৃত্বে রয়েছে ওই কলেজের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতা।
পরীক্ষা শুরুর কিছু পরেই কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন বাইরে চলে যাওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি রাজধানীর ইন্ধিরা রোডের তেজগাঁও কলেজের বিরুদ্ধে। ৩৩ তম বিসিএস, রাজস্ব কর্মকর্তা, থানা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া একাধিক চাকরিপ্রার্থী বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, পরীক্ষার হল থেকে শিক্ষককে পিয়নের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বাইরে পাঠিয়ে দিতে দেখেছেন তারা।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রশ্নপত্র কেন্দ্রের বাইরে পাঠানো এবং মোবাইলে উত্তর পাঠানোর এ সিন্ডিকেটের অন্যতম কর্ণধার হিসেবে উঠে এসেছে তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক ও ঢাবি’র সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেলের নাম। এ কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রশিদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুরাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার।
ইডেন কলেজ কেন্দ্র থেকেও প্রশ্নপত্র বাইরে চলে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সভাপতি নিপা’র সিন্ডিকেট পরীক্ষা হলের শিক্ষক ও বাইরের নষ্ট মেধাবীদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে দেয়। ক্লায়েন্ট ধরার কাজটিও নিপা এবং তার সহযোগীরা করে থাকে।
অভিযোগ রয়েছে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি ফুয়াদ হাসান পল্লবের বিরুদ্ধে। তবে পল্লবের হয়ে ক্লায়েন্ট সংগ্রহের কাজটি করে থাকে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাজিব। জড়িত রয়েছে এ কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাও।
পরীক্ষায় এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধ করতে কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করার নিয়মটি কঠোরভাবে মেনে চলা এবং মনিটরিং এর ওপর জোর দিয়েছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। না হলে ভবিষ্যতে দেশ অসৎ ও অযোগ্য কর্মকর্তাদের ফাঁদে পড়বে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, “এসব কারণে পরীক্ষার্থীরা নিজেদের শ্রম ও মেধার ওপর নির্ভর করতে পারছেন না। তারা বুঝতে পেরেছেন, টাকা-পয়সা দিয়ে তারা একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। এটা বর্তমানে এমনই প্রকট হয়েছে যে, এটা কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার নেই, সামষ্টিক ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেছে।”